রবিবার, ২৯ Jun ২০২৫, ০৫:৩৪ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

সমস্যার মধ্যে সমস্যা লুকিয়ে থাকার সমস্যা

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ:
ব্যাপারটা এভাবে গড়াবে প্রথম প্রথম ঠাওর করতে পারেননি রফিকুল ইসলাম। বিশেষ প্রতিবেদন তৈরির চাকরিতে বিশেষভাবে নিয়োগ লাভ করেছিলেন বিশেষ একজনের দ্বারা বিশেষ এক সময়ে। সবাই জানে এটা এক ধরনের খামের চাকরি। এই খাম যে সে খাম না, ডাক বিভাগের যে খাম ব্যবহারে এখন আর তেমন গরজ নেই অনেকের; এ খাম হৃদয় অনুভূতি লুকিয়ে পাঠানোর খামও নয়, আবেগ আদান প্রদান এখন হোয়াটস অ্যাপ, ভাইভার এমনকি ইমোতে চালাচালি চলে। এ খাম সে খামও না যে খামে অপ্রদর্শনযোগ্য অর্থ বিনিময় করেন কেউ কেউ ক্ষমতা কেনাবেচার সময়। এ খাম হচ্ছে সাধারণ নিয়োগ নীতিমালার আওতায় নয় বিশেষ বিশেষ কাজ করার জন্য বিশেষ নিয়োগ এটি। এক সময় নুলা, ফকির, দরবেশ সেজে অপরাধীদের গতিবিধির ওপর নজর রাখার জন্য এ জাতীয় চাকরি মিলত, যাকে টিকটিকির চাকরিও বলত অনেকে। আজকাল সেই টিকটিকির কাজ করারও ভোল পাল্টাচ্ছে। এখন নানানভাবে গোপনীয় তথ্য সংগ্রহ যাচাই বাছাই চলে। ফেসবুক, গুগল চাচা আছেন না? মোবাইল ফোনে এখন কথা রেকর্ড করা যায়, ছবি তোলা যায় সংগোপনে। একজনের মাথা আরেকজনের বডিতে লাগানোও নাকি যায়। হোমরা চোমরাদের গ্রুপ ছবিতে দাগি আসামিকে পরে ইনসার্ট করাও যায়। কত কিছু। রঙিন পোশাকধারীরা সাদা পোশাকেও এ-কাজে নামতে পারেন। বিশেষ চাকরি এখন বহুমাত্রিক।

রফিকুল ইসলামের মতো বিশেষ চাকরি পাওয়ার সময় কোনো কোটা মানার দরকার হয়নি বলে ব্যাপারটি তার অধিত বিদ্যার মধ্যে আসেনি। তার সিলেবাসেও এমন কিছু ছিল না। আবার পাস করার জন্য তাকে তেমন পরীক্ষাও দিতে হয়নি। তাই প্রশ্ন ফাঁসের ব্যাপারও মাথায় আসেনি। লিডারের কথামতো চলতেন বলে তার এ ধরনের বিশেষ চাকরি হয়েছে। জেলা, মেধা, গোষ্ঠী কিংবা অন্য কোনো সনদপ্রাপ্তির বিচার বিবেচনা বিশেষ এই চাকরি পাওয়ার সময় এসব কিছুরই প্রয়োজন পড়েনি। তাই রফিকুলের কাছে ব্যাপারটা প্রথমে তেমন একটা ঠাহরে আসেনি। একই গঞ্জে বাড়ি আরেক খাম সহকর্মী আবদুল মিয়া সেদিন হঠাৎ করে রফিককে জিগায় ‘ওস্তাদ ভাইভার প্রশ্ন ফাঁস হয় কেমনে?’ তাই তো! রফিক এটাও ভেবে দেখেনি। লিখিত পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস হয় জানি। ১৮ বিষয়ের মধ্যে ১২ প্রশ্ন পর্যন্ত ফাঁস হয়। গ্রোথ রেট খারাপ না। জিডিপি’র চেয়েও বেশি।

রফিকুল ইসলাম এবার বিশেষ প্রতিবেদন দেওয়ার সময় বেশ বিপাকে পড়লেন বলে তার মনে হচ্ছে। একটা পত্রিকায় কার্ল মার্কসের ওপর সে সময়কার একটা গোপনীয় প্রতিবেদন বাংলায় অনূদিত হয়ে ছাপা হয়েছে। জার্মান বিশেষ প্রতিবেদক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কার্ল মার্কসের মতো নেতাকে তার চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করে প্রতিবেদন দিয়েছে। কার্ল মার্কসের বড় ঘরের বড় টেবিলটার ওপর কোন জিনিস কীভাবে আছে তা এমন নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছে তাতে কাল মার্কস সাহেবের স্বভাব চরিত্র মনোভঙ্গি ব্যক্তিচরিত্র খোলস ও মুখোশের ছবি যেন উঠে এসেছে বর্ণনায়। তখন তো ডিএসএলআর ক্যামেরা, মোবাইল ফোন বা সেলফি তোলার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। বর্ণনার চাতুর্যে তার সব কিছু ফুটিয়ে তুলতে হয়েছে। রফিকুল ইসলামের এবারের সমস্যা হলো সমস্যার মধ্যে সমস্যা লুকিয়ে থাকার সমস্যাটা তার ধরতে সমস্যা হয়েছে। যে বিষয়ে যে ক্ষোভ যে আন্দোলন তা আপাত দৃষ্টিতে তাৎক্ষণিক বলে মনে হয়েছিল রফিকুলের। রফিকুল ভেবেছিলেন কতিপয় ক’জন আছে এর পেছনে এবং যেন তাদের শ্রেণি পরিচয় ও চরিত্রকে এপাশ ওপাশ করে দিতে পারলে তার প্রতিবেদন শুধু কেন, পুরো ব্যাপারটা থেকে পার পেয়ে যাবেন সবাই।

সিলেবাসের বাইরে পড়াতে গিয়ে আঁতেল টাইপের তার এক কলেজ শিক্ষক একদিন বলেছিলেন কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে পারার চেয়ে চালাকি আর নেই। বিপ্লব ঠেকাতে যে আন্দোলন করবে সেই আন্দোলনকে অন্যের দ্বারা অতিমাত্রায় কিছু করিয়ে তার ওপর দোষ চাপিয়ে দিতে পারলেই প্রসঙ্গকে সাজঘরে পাঠানো সহজ হয়। সেই অধ্যাপক চাণক্য প-িতের কথা বলেছিলেন। যে কোনো বিষয়ের দোষ চলমান কোনো নেতিবাচক ব্যবস্থাপনার ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পারলেই কেল্লাফতে। রফিকুল সে-রকম একটা নাটক কীভাবে সাজানো যায় এ নিয়ে ভাবতে ভাবতেই দেখা গেল মহানাটক হওয়ার জোগাড়যন্ত্র শেষ। অতিবিচক্ষণরাও যে এই নাটক বোঝার মতো জ্ঞান, কা-জ্ঞান ইতিমধ্যে হারিয়ে ফেলেছেন এটা নাট্য পটীয়সীদের মাথায় ঢোকেনি। নেড়া দুবার বেল তলায় যায় না এটা তারা বুঝতে পারেননি। ফলে যা হওয়ার তাই হলো- কেমন যেন ফুলেফেঁপে উঠলেন সবাই, সবকিছু। ‘ভাঙা রেকর্ড বাজাবার’ মওকা, মত বা ভিন্ন নাম পরিচয় দেওয়ার বা দেখাবার টেকনিকটাও বুমেরাং হয়ে দেখা দিল। ব্যাপারটা এমন হবে রফিকুল বুঝে উঠতে পারেননি।

চাকরি বাকরির ক্ষেত্রে সর্বত্র একধরনের অচলায়তন অবস্থা তৈরি হয়ে আছে বেশ কয়েক বছর ধরে। ঘরে ঘরে শিক্ষিত বেকারের চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার ব্যয় বেড়েছে কয়েক দশক ধরে। বিদ্যায়তনে শিক্ষক যা পড়াবেন সেটাই জ্ঞানার্জনের অন্যতম উৎস হওয়ার কথা ছিল। শিক্ষককে পুরো বেতন সরকারি খাত থেকে দেওয়ার নিয়ম হয়েছে। আগে শিক্ষকরা স্থানীয় ম্যানেজমেন্ট বা অভিভাবকদের থেকে বেতন পেতেন, ফলে পড়াশুনার তদারকিটাও হতো সেভাবে। পরে কিছু স্কুলে সরকার থেকে কিছু বেতন দেওয়া হতো। তদারকিটা তখনো ছিল স্কুল ম্যানেজমেন্টের কাছে। কিন্তু শিক্ষকরা আন্দোলন করে এমপিওসহ তাদের পুরো বেতন সরকার থেকে পাওয়ার ব্যবস্থা আদায় করে নিয়েছেন। স্থানীয় ব্যবস্থাপনার তদারকির সুযোগ ও অধিকার তখন থেকে উধাও। সরকারের পক্ষে সরকারি কর্মকর্তা এবং জনপ্রতিনিধিরা স্কুল পরিচালনা পর্ষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দায়িত্বে আসেন। তখন শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে তত্ত্বাবধান সবই ভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা সরকারি আমলার করায়ত্তে, যদিও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি মহোদয়ের হাতে সবকিছু। এর ফলে এখানে রাজনীতি ঢুকে গেল। শিক্ষকরাও জাতীয় নির্বাচনের আগে সরকারকে নাজুক অবস্থায় ফেলবার অজুহাতে তাদের সব দাবি-দাওয়া দায়িত্ব পালনের সব ব্যবস্থা নিজেদের মতো পেয়েছেন। ফলে ক্লাসে পড়ানোর চেয়ে মোটা উৎকোচ দিয়ে অদক্ষ শিক্ষক প্রাপ্ত চাকরির টাকা তোলার জন্য রীতিমতো বেনিয়া মুৎসুদ্দিদের বাণিজ্যিক মনোভাবে চলে যান। তিনি ক্লাসে না পড়িয়ে কোচিং সেন্টারে পড়ানোর পথে যান, পরীক্ষার প্রশ্ন বলে দেন, ফাঁস করিয়ে দেন, ছাত্রদের নকল করার সময় ‘বুদ্ধিমানের মতো’ চোখ বুজে থাকেন- কারণটা আর্থিক। এর বিপরীতে যারা ন্যায় নীতিবান দায়িত্বশীল শিক্ষক, তারা নানাবিধ কারণে একঘরে হয়ে পড়েছেন।

এহেন অবস্থায় শিক্ষার ব্যয় বেড়েই চলেছে। প্রতি বছর প্রচুর শিক্ষার্থী সার্টিফিকেট নিয়ে বের হচ্ছে। শিক্ষার হার বাড়ার বা বাড়ানোর একটা লক্ষ্য থেকে পাসের হার বেড়ে যায় বা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু এর বিপরীতে চাকরি সৃষ্টি হয়নি এবং যা আছে সেখানে প্রবেশের পথে নানান বাধা। কারণ সেখানে ব্যাপক বাহানার প্রতিযোগিতা। শিক্ষার গুণগতমানের দিকে নজর না থাকায় পাস করা শিক্ষার্থীরা চাকরির পরীক্ষায় পেরে ওঠে না। সরকারি চাকরিকে সোনার হরিণ মনে করে অধিক হারে উৎকোচ দিয়ে কিংবা ভিন্ন পথ-পন্থায় মেধাবীদের হটিয়ে অ-মেধাবীরা এসে দখল করছে সব কিছু। মেধাবীদের হটানোর আরেকটি উপায় কোটার নামে অনেকের অহরহ চাকরি পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি। বেসরকারি খাতে যেখানে চাকরি বেশি, বিশেষ করে গার্মেন্টস খাতে বা আর্থিক খাতে ভালো মানের চাকরি (সুপারভাইজার, ডিজাইনার, ম্যানেজার), সেগুলোতে দেশি শিক্ষিতরা দাঁড়াতে পারছে না। ফলে সেখানে বিদেশিরা এসে বেশি বেতনে সে চাকরিগুলো নিয়ে যাচ্ছে। দেশের শিক্ষিত বেকারের লাইন বড় হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চাকরির বয়স চলে গিয়ে যারা স্থায়ী বেকারের সারিতে শামিল হচ্ছে তাদের লাইন বড় হচ্ছে। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট-এর ঢোল পেটানো হচ্ছে, উন্নয়নশীল হওয়ার পথে পা বাড়ানোকে বড় করে দেখানো হচ্ছে। কিন্তু সেই ডিভিডেন্ট ডিজাস্টারে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা এবং উন্নয়নশীলে টিকে থাকার জন্য প্রয়োজন গুণগতমান সম্পন্ন শিক্ষার শক্তিতে বলবান দক্ষ জনবল সে বিষয়ক বিচার বিবেচনাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার যন্ত্রণায় যেন ভুগছে সবাই।

এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজছে সবাই। বের হওয়ার পথ পেতে হবে। এক ধরনের বঞ্চনাবোধ সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে দানা বাঁধছে। রফিকুল এভাবে বিষয়টির গভীরে যেতে পারেননি। এটা ঠিক রফিকুলের কাছে যেমনটি মনে হয়েছে এ বিষয়টি যেন হঠাৎ করে দানা বেঁধে অগ্ন্যুৎপাতের পথে গিয়েছে। তিনি আগেভাগে ঠাওর করতে পারেননি। পারেননি আরও অনেকে। অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানোয় অভ্যস্তরাও কয়দিক সামাল দেবেন, এমন এক ধরনের ব্যতিব্যস্ততায় এ বিষয়টি বেমালুম ভুলতে বসেছেন যেন। সে কারণে ঘটনা ঘটার পর তা ভিন্ন খাতে নেওয়ার ছক সাজিয়েও তা কাজে দেয়নি। ঈশান কোণে কাল মেঘ এখনো রয়েছে। রফিক তার বিশেষ প্রতিবেদন শেষ করলেন এ কথা বলে যে, আকাশে ঝড়বৃষ্টির পাক সাক হচ্ছে। অসময়ে বিদ্যুৎ ঝড়ের মতো আচমকা অভিভূত করে দিতে পারে সবাইকে।

লেখক: উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক

mazid.muhammad@gmail.com

ভয়েস/আআ/সূত্র: দেশ রূপান্তর

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION